শনিবার, ১১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

ডাক্তার-নার্সদের অক্লান্ত পরিশ্রম যা মিডিয়ায় আসে না


জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিউটের সিসিউতে ভয়ানক কয়েক ঘন্টা।
বুধবার রাত ১১ টা।
হঠাৎ করে হাসপাতালের সিসিইউ রুমের গেটের দিকে শোরগোল। দ্রুত ট্রলি নিয়ে ছুটলেন কয়েকজন সেদিকে। তাতে তুলে আনা হল মাঝবয়েসি এক যুবককে। পরনের জামা-কাপড় দেখে বুঝা গেল দরিদ্র ঘরের সন্তান। হার্ট অ্যাটাক করেছে তার। মৃত্যুর একেবারে কাছাকাছি সে। ডাঙায় পড়ে যাওয়া পুটি মাছের মতো তরপাচ্ছিল সে। বাঁচবে যে, তেমন আশাও নেই।
ইতোমধ্যে স্বজনরাও মহাকান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। নার্স-ডাক্তাররা কয়েকজন রুম থেকে বের করে দিলেন সেই স্বজনদের। এরপর যা শুরু হল, তা দেখে একজন সুস্থ্য মানুষও অজ্ঞান হবার দশা। একজন জওয়ান পুরুষ নার্স তার বুকের ওপর ইয়া শব্দ করে আঘাত শুরু করলেন। একজন সুস্থ মানুষকে ওভাবে আঘাত করলে সে নির্ঘাত দম বন্ধ হয়ে মারা যেতো।
যাই হোক, এই ধুরুমধারুম আঘাত চলল মিনিট দশেক। এরপর কাজ না হওয়াতে নিয়ে আসা হল কাপড় ইস্ত্রি করার মতো দুটি শক দেবার যন্ত্র। এই জিনিস আমি শুধু সিনেমাতেই দেখেছি। এরপর সেটি দিয়েও চলল ‘’নির্যাতন’’। একদিকে যমে টানছে যুবককে, আরেক দিকে বাংলাদেশের হাসপাতালের কয়েকজন অসহায় নার্স। তাদের নেতৃত্বে একজন ডাক্তার।
এ কাজ করতে গিয়ে ঘেমে নেয়ে একাকার সবাই। বাইরে পাল্লা দিয়ে চলল যুবকটির পরিবারের কান্না।
আমি অনেক শক্ত মানসিকতার মানুষ। কিন্তু তারপরও বারবার ভেতরে ভেতরে চুরমার হচ্ছিলাম। কিন্তু বুঝতে দিচ্ছিলাম না। কারণ আমার পাশেই আমার নিজের রোগি আছে। তিনি আমার শ্বাশুড়ি। তিনি যদি বুঝতে পারেন আমার নিজেরই এই অবস্থা, তিনি ভেঙে পড়বেন। তাকে সাহস যোগালাম।
এদিকে শুনতে পেলাম নার্সরা বলাবলি করছে, এ যাত্রা বেঁচে গেলো ছেলেটি। আমিও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
আমি তখন চিকিৎসক ভলান্টিয়ার দলটির দিকে তাকালাম। দেখলাম সবার মুখে বিজয়ের হাসি চিকচিক করছে। মনে হচ্ছিল তারা এই মাত্র এভারেস্টের চূড়া জয় করে ভোরের তাজা আলোর আভা সারা মুখে মেখেছে। জানতে পারলাম এভাবেই সারারাত ধরে নতুন কোনো রোগির সেবায় দৌড় শুরু করে তারা।
[আমরা যারা প্রতিদিন মজা করে ঘুমাই, ঠিক সেই মূহুর্তে রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটের সিসিইউতে প্রতি রাতে চলে জীবন-মৃত্যু নিয়ে ’’দরকষাকষির এই খেলা’’। প্রতিরাতে গড়ে কমপক্ষে চারজন মারা যায়। আমরা কখনো কখনো সে কথা পত্রিকায় পড়ি। কিন্তু আমাদের ডাক্তার-নার্সদের অক্লান্ত পরিশ্রমে যে আরও ২০/৩০ জন বেঁচে যায়, তাদের কথা কীভাবে যেন পত্রিকার পাতায় ঠাঁই পায় না।]

লেখা - লুৎফুর রহমান হিমেল

নিউজ এডিটর - বাংলাদেশ প্রতিদিন

SHARE THIS

0 মন্তব্য(গুলি):