রবিবার, ৯ আগস্ট, ২০১৫

দেরীতে হলেও জীবনে সবকিছু পেয়েছি : প্রফেসর ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ

ছোটবেলায় প্রশাসনিক কর্মকর্তা হতে চেয়েছিলেন ছেলেটি। তখন পাকিস্তান আমল, প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের চাল চলন, হাবভাব দেখে বেশ ভালো লাগত তাঁর। ভাবতেন বড় পদ, বড় অবস্থান; এই কাজেই বোধহয় অনেক সম্মান! তাই তো এমন সিদ্ধান্ত। তবে শেষে আর প্রশাসনিক কর্মকর্তা হয়ে ওঠা হয়নি। হলেন চিকিৎসক। যার কথা বলছি, তিনি দেশের খ্যাতিমান চিকিৎসক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক এবং মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ। এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে দেশে যখন ডেঙ্গু জ্বর একটি আতঙ্কের নাম, তখন জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি অসংখ্য রোগীকে সফলভাবে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তুলেছিলেন তিনি। তাঁর প্রকাশিত চিকিৎসাবিষয়ক বইগুলো দেশে-বিদেশে বেশ সমাদৃত এবং পঠিত। ওষুধের ভুল ব্যবহার, অপচিকিৎসার কুফল, চিকিৎসক এবং রোগীর সম্পর্ক নিয়ে সারা বছরই তাঁর কলম থাকে সক্রিয়। মিষ্টভাষী, সুহৃদ এই মানুষটি বলেছেন তাঁর জীবনের গল্প।    



 DownLoad Link of  Short Cases In 
  Clinical Medicine  

ক্লাসে ফার্স্ট ছিলাম, তবে শিক্ষার্থী ছিল পাঁচজন 

১৯৫৪ সালে জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার হাড়িয়াবাড়ী গ্রামে আমার জন্ম। আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের ছিলাম। অর্থনৈতিকভাবে তেমন সচ্ছল ছিলাম না। আমরা দুই ভাই। একান্নবর্তী পরিবারে বড় হয়েছি আমি। শিক্ষা জীবনে প্রথম জামালপুর হারিয়াবাড়ী প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হই। প্রাইমারি স্কুল শেষে ইসলামপুর নেকজাহান হাইস্কুলে ভর্তি হই। এরপর স্বাধীনতার আগে ৬৯ সালে থেকে এসএসসি পাস করি। ওই সময় এখনকার মতো এত সুযোগ ছিল না।


সীমিত সুযোগে লেখাপড়া করতে হয়েছে। ক্লাসে শিক্ষার্থী ছিল পাঁচজন। কম শিক্ষার্থীদের কারণে একটা সুবিধা ছিল, ক্লাসে ফার্স্ট হতাম। হা হা হা...। শিক্ষকরা নজর দিত খুব। 

স্কুলে পড়ার সময় একবার সাঁতার না জানার কারণে পুকুরে ডুবে মারা যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল। পাশ থেকে কেউ একজন দৌড়ে এসে উদ্ধার করে। আরেকবার গাছে উঠে জাম পারতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। গুরুতর আঘাত পাওয়ার আশঙ্কা থাকলেও কোনো ক্রমে বেঁচে যাই সেবারও। ছোটোবেলায় অনেক খেলা করতাম। হাডুডু, দাঁড়িয়াবান্ধা এগুলো খেলতাম। স্কুলে প্রতিবছর খেলা প্রতিযোগিতা হতো, সেখানে পুরস্কার পেতাম।

যখন স্কুলে পড়ি, ভাবতাম প্রশাসনিক বড় পদে ঢুকব। পরে মনে হলো, বড় পদে কাজ করলে বড় হওয়া যায় ঠিকই, কিন্তু সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে না। বাবা-মা চাইতেন আমি যেন ডাক্তার হই। ডাক্তার হলে মানুষের সাহায্য করা যায়, জনগণের কাছাকাছি যাওয়া যায়। পাশাপাশি তখনকার সময় দেশে চিকিৎসকদের চাহিদাও বেশি ছিল। এই ভাবনা থেকেই চিকিৎসা পেশায় আসা। 

অপূর্ণতা রয়ে গেছে

এসএসসি পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হলাম। ঢাকা আসার পরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল। এর মধ্যে পড়াশোনা করতাম। এরপর ওলো একাত্তর সাল। শুরু হলো স্বাধীনতা সংগ্রাম। ঢাকার অবস্থা বেশ খারাপ ছিল। তখন পুরো সময়টায় গ্রামেই কাটিয়েছি। ১৯৭২ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করি। তখন মেডিকেল কলেজ ছিল আটটা, প্রতিযোগিতা ছিল অনেক। এ সময় সরাসরি ঢাকা মেডিকেল কলেজে সুযোগ পাই। স্বাধীনতার পর প্রথম ব্যাচ আমরাই ছিলাম। 

মেডিকেলে পড়লে কঠিন পরিশ্রমের মধ্যে সময় কাটাতে হয়। প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছে লেখাপড়ায়। ’৭৮ সালে এমবিবিএস পাস করে বের হই। এরপর চাকরি নিয়ে গ্রামে এসেছিলাম। তারপর আবার  ঢাকা মেডিকেলে পোস্টিং হয়েছিল। 

১৯৮৪ সালের দিকে জোয়ার এলো বিদেশে যাওয়ার। অনেকে বিদেশে কাজের জন্য যেতে চাইল। আমিও কিছুদিন সৌদিতে ছিলাম। বিদেশে গেলে ভালো সম্মানী পাওয়া যেত। লোভনীয় চাকরির আশা বাদ দিতে পারিনি। সৌদিতে পাঁচ বছর থাকার পর যদিও টাকা মিলল, তবে বুঝতে পারলাম কী যেন একটা অপূর্ণতা রয়ে গেছে আমার ভেতর। বুঝলাম, এই অপূর্ণতা উচ্চশিক্ষা গ্রহণের, যদিও তখন অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল হয়েছিলাম।

লন্ডনের জীবনযাত্রা অনেক ব্যয়বহুল ছিল 

১৯৯২ সালে লন্ডনে গেলাম উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য। লন্ডনের রয়েল কলেজ অব ফিজিশিয়ান থেকে এমআরসিপি ডিগ্রি অর্জন করি। ওই সময় আমাদের একটা অসুবিধা ছিল। ব্রিটিশ মেডিকেল কাউন্সিলে বাংলাদেশের মেডিকেল শিক্ষাকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হতো না। তাই চাকরি ভালো জায়গা হওয়া সম্ভব হতো না। এর মধ্যে লেখাপড়া চালাতে থাকলাম। সেখানে জীবনযাত্রা অনেক ব্যয়বহুল। তাই জীবন অনেক কঠিন ছিল। এরপর এমআরসিপি পেলাম। কিছু ভালো হাসপাতালে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছি। পাস করার পর বাইরের দেশে যাওয়ার লোভনীয় অফার ছিল। এরপরও দেশে চলে আসি। বাইরে ভালো লাগত না। দেশের মানুষের জন্য চলে এলাম। মনে হলো, এত ডিগ্রি নিয়ে দেশের বাইরের লোকদের সেবা করব! এর চেয়ে দেশের মানুষের সেবা ভালো। তবে একটা ভয় ছিল, দেশে কাজ করার সুযোগ পাব কি না। এসে হলিফ্যামিলি মেডিকেল কলেজে মেডিসিন বিভাগে যোগ দিলাম পরামর্শক হিসেবে। দুই বছর থাকলাম।

এরপর পিএসসি পরীক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে ১৯৯৫ সালে তৎকালীন আইপিজিএমআর (পিজি)-এর সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করি। এখন পর্যন্ত এখানে মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক এবং মেডিসিন বিভাগের ডিন হিসেবে রয়েছি, এখানেই সেবা দিচ্ছি। 


দেরি হলেও জীবনে সবকিছু পেয়েছি

মনে হয় আমার জীবনে কোনো ব্যর্থতা নেই। আল্লাহর রহমতে জীবনে ব্যর্থ হয়েছি বলে মনে হয় না। কিছু সময় দেরিতে হলেও যা চেয়েছি সেটা পেয়েছি। আসলে চাহিদার তো আর শেষ নেই, তারপরও মনে হয় নিজস্ব আর কোনো চাহিদা নেই। এখন ব্যস্ত থাকি রোগীর চিকিৎসা দেওয়া নিয়ে। পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ছাত্রদের শিক্ষাদান, জ্ঞানদান করি। অবসরে স্বাস্থ্যবিষয়ক লেখালিখি করি। বড় বড় পত্রিকাগুলোতে লেখা প্রকাশ হয়। এ ছাড়া মেডিকেল বিষয়ে পাঁচটি বই প্রকাশিত হয়েছে।
Short cases in clinical medicine, Radiology in medical practice, Data interpretation of medical practice, ECG in medical practice, Long case in clinical medicine, স্বাস্থ্যবিষয়ক নির্বাচিত কলাম। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই এই বইগুলো পড়া হয়। ইন্টারনেটের মাধ্যমে বইগুলো পড়া যায়। Short cases in clinical medicine বইটি ইউজিসি ইউনির্ভাসিটি গ্র্যান্ড কমিশনে ২০১৩ সালে পুরস্কৃত হয়েছে। এর মধ্যে দৈনন্দিন স্বাস্থ্যবিষয়ক সমস্যা, সাধারণ মানুষের জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যই বইগুলো লেখা। বইগুলো প্রচুর গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এ ছাড়া পরপর দুবারের জন্য ডিন নির্বাচিত হয়েছি প্রফেসরদের প্রত্যক্ষ ভোটে।

১৯৮৩ সালে বিয়ে করি। আমার স্ত্রী মাহমুদা বেগম একটি কলেজে অধ্যাপনা করেন। এক ছেলে ও এক মেয়ে। তারা দুজনই চিকিৎসক।

রোগীকে সুস্থ করে তুলতে পারলে ভালো লাগে

১৯৭৯ সালে যখন পাস করে জেনারেল চিকিৎসক হিসেবে গ্রামে পোস্টিং হলো, তখন একটি ডেলিভারির ডাক আসে। ঘটনাটি ছিল এ রকম-বাচ্চার শরীর বের হয়েছে, তবে মাথা পেটের ভেতর রয়ে গেছে। ওই পরিবারটির সামর্থ্য ছিল না রোগীকে শহরে নিয়ে আসার। আমাকে সেই রোগীর চিকিৎসার জন্য ডাকল। আমি তো গাইনোকোলজিস্ট নই। কীভাবে এই কাজ করব? দ্বিধায় পড়ে গেলাম। পরে মনে হলো, দেখা যাক আগে রোগীর জীবন রক্ষা করা জরুরি। মজার বিষয় হলো, আল্লাহর রহমতে প্রসবটি সফল হয়েছিল। ওই শিশুটি এখন বড় হয়েছে, সেও চিকিৎসক। 

কোনো রোগীকে সুস্থ করে তুলতে পারলে খুব ভালো লাগে। এই শতাব্দীর শুরুর দিকে ডেঙ্গু জ্বরের খুব প্রকোপ হয়েছিল। তখন অনেক রোগীকে চিকিৎসা করে সফলভাবে সুস্থ করে তুলতে পেরেছিলাম। মানুষের মধ্যে ভীতি ছিল ডেঙ্গু জ্বর হলে আর বাঁচে না। কিন্তু আল্লাহর রহমতে এক থেকে দুজন ছাড়া সবাই ভালো হয়েছিল।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে যখন কারাগারে ছিলেন, আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তাঁর চিকিৎসার জন্য। তখন তাঁর চিকিৎসার সুযোগ হয়েছিল। আমি মনে করি, ব্যক্তিগত জীবনে অর্জন অনেক হয়েছে। 

নতুন যাঁরা 

চিকিৎসকরা আর মহৎ নেই এ বিষয়ে মানুষের যে অভিযোগ, সেটা পুরোপুরি অযৌক্তিক নয়। কোনো পেশাই যেন এখন আর মানবিক নেই। পুরোদমে ক্যানসারাস পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। চিকিৎসকরাও আর এর বাইরে নেই!
তবে অধ্যবসায়ের মাধ্যমে, শ্রম দিয়ে, মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে হবে। অন্য পেশার মতো এই পেশা নয়। এটা অনেক স্পর্শকারতর পেশা। তাই ভালোভাবে না লেখাপড়া করলে ভালো চিকিৎসক হওয়া যাবে না। তখন চিকিৎসক আর রোগীদের দূরত্ব বাড়তে থাকবে। 

শিক্ষার্থীরা যেন আমার চেয়ে সুনাম পায়মেডিকেল নিয়েই এখন আমার বেশি চিন্তা। কিছু বইপুস্তক লেখা হয়েছে তা পড়ে যেন শিক্ষার্থীদের ভালো হয় এটা চাই। নিজে যতটুকু অর্জন করেছি, এটা যেন ধরে রাখতে পারি। এখন হাসপাতালে ব্যস্ততার মাঝে সময় কাটে। বিকেলে চেম্বারে প্র্যাকটিস করি। নিজের এলাকায়, গ্রামে সামাজিক কিছু কাজ করি। এগুলো করতে পারলে ভালো লাগে। আমার জমিতে সরকারের মাধ্যমে ক্লিনিক করেছি। এতে এলাকার মানুষের উপকার হচ্ছে। আমি মনে করি, মানুষ তো আর বেঁচে থাকবে না। তবে জীবনের শেষ পর্যন্ত কিছু ভালো কাজ করতে পারলে সেটাই রয়ে যাবে। 

এখন আশা আমার শিক্ষার্থীরা, আমরা সন্তানরা যেন ভালো চিকিৎসক হয়ে দেশের মানুষের সেবা করতে পারে। আমার ছাত্ররা যেন আমার থেকেও ভালো করে। তাদের সুনাম বাড়লে সেটা আমার জন্য বড় পাওয়া হবে।

SHARE THIS

0 মন্তব্য(গুলি):